পরিবেশ বিজ্ঞান ও জীববৈচিত্র্য বাংলাদেশের বর্তমান চ্যালেঞ্জ

পরিবেশ বিজ্ঞান ও জীববৈচিত্র্য: বাংলাদেশের বর্তমান চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু সংবেদনশীল দেশ ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত হলেও, বর্তমানে এ দেশ এক  গভীর পরিবেশগত সংকটে নিপতিত। ছোট্ট আয়তনের এই দেশটি প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বসবাসস্থল, যার ফলে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১,২৫০ জনের বেশি মানুষ বাস করে—এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। এত বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ আজ মারাত্মক চাপে রয়েছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, পূর্বে পাহাড় ও বৃষ্টিবহুল বনাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমে খরা প্রবণ এলাকা—এই ভৌগোলিক বৈচিত্র্য দেশটিকে প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য এক অনন্য আবাসস্থল করে তুলেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, ভূমি দখল ও দূষণের কারণে এই জীববৈচিত্র্য আজ চরম হুমকির মুখে।

🛑জলবায়ু পরিবর্তন: এক দীর্ঘস্থায়ী সংকট

  •       Global Climate Risk Index 2021 অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।
  •       IPCC Sixth Assessment Report মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭% ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যার ফলে প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।
  •       প্রতি বছর গড়ে ১০-১২টি বড় ধরনের দুর্যোগ (ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা) সংঘটিত হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ছে, কৃষিজমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে, এবং পানি সংকটও তীব্রতর হচ্ছে।

🛑জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয়: বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি

  •       IUCN Bangladesh Red List 2015 অনুসারে:

o   ১,৬১৯টি প্রাণী প্রজাতি সনাক্ত করা হয়েছে।

o   এর মধ্যে ৩৯০টি প্রজাতি বিপন্ন, ১৭টি বিলুপ্তপ্রায়।

  •       ৫,০০০+ উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে, যার অনেকগুলো বিরল ও স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
  •       প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংসের ফলে বাঘ, গাঙ্গেয় ডলফিন, উল্লুকসহ বহু প্রজাতির অস্তিত্ব হুমকির মুখে।

বনভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অবস্থা

  •       FAO 2020 অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট ভূমির মাত্র ১৪.১% বনভূমি (সামাজিক বনসহ)।
  •       গত ৩০ বছরে প্রাকৃতিক বনভূমির পরিমাণ ৩০–৩৫% কমেছে
  •       সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিমি, যা দেশের মোট বনভূমির ৪৪%। কিন্তু শিল্পায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনে এর অস্তিত্বও ঝুঁকির মুখে।

🛑পরিবেশ দূষণ: বেঁচে থাকার মৌলিক ঝুঁকি

  •       বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য ফেলা হয়।
  •       ঢাকার Air Quality Index (AQI) ২০২৪ সালের শীতকালে প্রায়শই ২০০–৩০০ ছুঁয়েছে, যা “Very Unhealthy” হিসেবে চিহ্নিত।
  •       World Bank (2021) মতে, বাংলাদেশে বছরে ৮ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে মাত্র ৩৬% পুনর্ব্যবহার হয়।

এছাড়া, কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, ইটভাটা, এবং অনিয়ন্ত্রিত শিল্পবর্জ্য পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।

🛑বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি সংরক্ষণের উপায়

বাংলাদেশে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, গাঙ্গেয় ডলফিন, পাহাড়ি কাঠবিড়ালি, উল্লুকসহ বহু বিরল প্রজাতি আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এদের রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন পরিকল্পিত, বহুমাত্রিক ও বাস্তবভিত্তিক   কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় ~

  •       প্রাকৃতিক বাসস্থান সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার: বনাঞ্চল, জলাভূমি, নদী ও পাহাড়ি এলাকা সংরক্ষণ ছাড়া বন্যপ্রাণী টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অবৈধ দখল ও বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি।
  •       অভয়ারণ্য ও সংরক্ষিত এলাকার সম্প্রসারণ: বর্তমানে দেশের ৪০টির বেশি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও ৪টি অভয়ারণ্য রয়েছে। এ সংখ্যা বাড়িয়ে ছোট ছোট ‘মাইক্রো রিজার্ভ’ বা ‘জীববৈচিত্র্য করিডোর’ তৈরি করা দরকার।
  •       বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ: বন্যপ্রাণীর আচরণ, সংখ্যা ও বাসস্থান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে GPS কলার, ক্যামেরা ট্র্যাপ ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
  •       বন্যপ্রাণী পাচার ও শিকার বন্ধে আইন প্রয়োগ: বন্যপ্রাণী পাচার রোধে সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি ও কমিউনিটি প্যাট্রোল গঠন জরুরি।
  •       স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও বিকল্প জীবিকা: স্থানীয়দের বিকল্প আয়সুত্র প্রদান যেমন ইকো-ট্যুরিজম, মৌচাষ ইত্যাদি প্রচলন করলে বন ও প্রাণী সংরক্ষণ সহজ হবে।
  •       উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র: আহত বা বিপন্ন প্রাণীদের জন্য উদ্ধার কেন্দ্র ও পুনর্বাসন ব্যবস্থার প্রয়োজন।
  •       আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বাড়িয়ে সংরক্ষণ কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

🛑চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়

১. আইন প্রয়োগের কঠোরতা: পরিবেশ সংরক্ষণ আইন কার্যকর করা এবং অবৈধ দখল বা বর্জ্য ফেলার বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করা।

২. প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ ও পুনরায় বনায়ন: বিশেষ করে উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকায়।

৩. স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি ও টেকসই চাষাবাদ: পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে চাষাবাদে উৎসাহ দেওয়া।

নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ: সোলার ও বায়ু বিদ্যুতে জোর দেওয়া।

৫. সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও কমিউনিটি পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

৬. গবেষণা ও ডেটা ভিত্তিক নীতিনির্ধারণ: পরিবেশ পরিবর্তনের ওপর স্থানীয় গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহে বিনিয়োগ বাড়ানো।

🛑উপসংহার

পরিবেশ বিজ্ঞান ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আর বিলাসিতা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার অপরিহার্য অংশ। যদি এখনই সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাব এক বিষাক্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবী। প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান শেখা, তার উপর নির্ভরতা কমানো এবং বিজ্ঞান ও সচেতনতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পরিবেশগত ন্যায়ের পথে হাঁটা আমাদের দায়িত্ব।পরিবেশ বাঁচানো মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্ব রক্ষা করা~ এ দায় শুধু রাষ্ট্রের নয়, বরং প্রতিটি নাগরিক এর

Table of Contents

Explore by Topics

Research Tips

Practical strategies to enhance your research efficiency

Career & Higher Studies

Insights Latest advancements and tutorials in Bioinformatics

Drug Design

Explore innovations in molecular docking and drug discovery

News & Events

Guidance on scholarships, SOPs, CV writing, and professor communication

Bioinformatics

Practical strategies to enhance your research efficiency

Want to Stay Updated?

Subscribe to our Newsletter and never miss out...

Company Information

Registered Company Name:

Innovative Research Center

Trade License Number:

TRAD/DNCC/047184/2024

TIN Number:

380164652827