খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বোঝায়—প্রতিটি মানুষের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে পর্যাপ্ত, পুষ্টিকর এবং নিরাপদ খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, যা একটি সুস্থ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয়। এটি শুধু খাদ্যের পরিমাণ নয়, গুণমান, প্রাপ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং পরিবেশগত টেকসইতাও এর অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিজমির সঙ্কুচন, বন্যা-খরা ইত্যাদি সমস্যার কারণে খাদ্য উৎপাদন ঝুঁকির মুখে পড়ছে। এর সমাধানে জৈব প্রযুক্তি হয়ে উঠছে সময়োপযোগী একটি হাতিয়ার।
🛑জৈব প্রযুক্তি
জৈব প্রযুক্তি (Biotechnology) হলো জীবজগতের উপাদান—যেমন DNA, RNA, এনজাইম, কোষ ইত্যাদি—ব্যবহার করে মানুষের কল্যাণে নতুন পণ্য বা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বিজ্ঞান। কৃষিতে এর প্রয়োগকে এগ্রি-বায়োটেকনোলজি বলা হয়, যার মাধ্যমে তৈরি হয় উচ্চফলনশীল, রোগ-প্রতিরোধী ও খরাপ্রতিরোধী ফসল।
🌾 খাদ্য নিরাপত্তায় জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার
১. জেনেটিকালি মডিফায়েড (GM) ফসল:
জৈব প্রযুক্তির অন্যতম বড় অর্জন হলো জিন-পরিবর্তিত (Genetically Modified) ফসল। যেমন—
- Bt বেগুন: এটি বাংলাদেশে সফলভাবে চাষ হচ্ছে। এতে একটি ব্যাকটেরিয়ার জিন প্রবেশ করানো হয়, যা ক্ষতিকর পোকা দমন করে। কীটনাশকের ব্যবহার কমে এবং উৎপাদন বাড়ে।
- সোনালী ধান (Golden Rice): ভিটামিন A-এর ঘাটতি দূর করার জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে এই ধান, যা দৃষ্টিশক্তি রক্ষা ও শিশুমৃত্যু রোধে কার্যকর।
২. টিস্যু কালচার ও ক্লোনিং:
শ্রেষ্ঠ গুণের উদ্ভিদের টিস্যু ব্যবহার করে বিপুল সংখ্যক গাছ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। এতে সময় ও জমির অপচয় কমে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
৩. জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি (CRISPR/Cas9):
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ফসলের জিনে নির্দিষ্ট পরিবর্তন এনে রোগ প্রতিরোধ, পুষ্টিমান বৃদ্ধির মতো বৈশিষ্ট্য সংযোজন করেন। এটি ভবিষ্যতের কৃষিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
এছাড়াও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে –
- FAO-এর তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতি ৯ জনে ১ জন এখনো অপুষ্টিতে ভুগছে।
- বাংলাদেশে প্রায় ৩০% শিশুর ওজন বয়সের তুলনায় কম।তাই জাতিসংঘের SDG-2 লক্ষ্য: 2030 সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়া।
এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে খাদ্য উৎপাদনে গুণগত এবং পরিমাণগত বিপ্লব প্রয়োজন, যা জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্ভব।
🛑 বাংলাদেশে জিএম ফসলের বর্তমান অবস্থা
জিন-পরিবর্তিত ফসল (GM Crops) বর্তমানে বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন ও পরিবেশবান্ধব চাষাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে জিএম ফসল বাণিজ্যিকভাবে চাষে অন্যতম অগ্রগামী দেশ। দেশের জিএম ফসল কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো Bt বেগুন।
Bt বেগুন:
- ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রথম অনুমোদন দেয় এবং ২০১৪ সালে বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়।
- এটি Bacillus thuringiensis (Bt) নামক একটি ব্যাকটেরিয়ার জিন ধারণ করে, যা লিভ বোরার নামক ক্ষতিকর পোকা দমন করে।
- বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪ জেলাতেই Bt বেগুন চাষ হচ্ছে।
- গবেষণায় দেখা গেছে, Bt বেগুনে:
- কীটনাশকের ব্যবহার ৮০% পর্যন্ত কমে,
- উৎপাদন ৩০-৪৫% পর্যন্ত বাড়ে।
বাংলাদেশে আরও কিছু জিএম ফসলের ওপর গবেষণা চলছে—
- Golden Rice (ভিটামিন A সমৃদ্ধ ধান) – BRRI উদ্ভাবন করেছে এবং বর্তমানে বাণিজ্যিক অনুমোদনের অপেক্ষায়।
- লবণসহিষ্ণু ধান ও খরা প্রতিরোধী ধান – উন্নয়ন পর্যায়ে রয়েছে।
- পেঁপে ও আলুর ভাইরাস প্রতিরোধী জাত – গবেষণাধীন।
🌍 বিশ্বজুড়ে জিএম ফসলের চাষ:
ISAAA (International Service for the Acquisition of Agri-biotech Applications) এর ২০২৩ সালের তথ্যমতে:
- বর্তমানে ৭০টিরও বেশি দেশে কোনো না কোনোভাবে জিএম ফসল ব্যবহার বা আমদানি করা হয়। এবং ২৯ টি দেশে বাণিজ্যিকভাবে জিএম ফসল চাষ হয়।
- শীর্ষ জিএম ফসল উৎপাদনকারী দেশগুলো:
- 🇺🇸 যুক্তরাষ্ট্র
- 🇧🇷 ব্রাজিল
- 🇦🇷 আর্জেন্টিনা
- 🇮🇳 ভারত (Bt cotton)
- 🇨🇳 চীন
বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়া জিএম ফসলে প্রধানত রয়েছে:
- Bt cotton
- GM soybean
- GM maize (ভুট্টা)
- GM canola
- Golden Rice
🛑 চ্যালেঞ্জ
যদিও জিএম ফসল খাদ্য নিরাপত্তায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- জিএম খাদ্য নিয়ে জনমনে ভীতি ও বিভ্রান্তি রয়েছে – যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ক্যান্সারের ভয়।
- পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ, যেমন জীববৈচিত্র্যের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব।
- বীজের মালিকানা ও বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য, যা কৃষকদের নির্ভরশীল করে তোলে।
🌿 টেকসই কৃষি পদ্ধতি
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শুধু উৎপাদন বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন টেকসই কৃষি—যা মাটি, পানি, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন বজায় রাখতে সক্ষম। টেকসই কৃষির কিছু মূল উপাদান হলো:
১. জৈব কৃষি (Organic Farming):
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদ। এতে পরিবেশ দূষণ কমে এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা পায়।
২. সমন্বিত পোকা ব্যবস্থাপনা (IPM):
পোকা দমনে শুধুমাত্র কীটনাশকের উপর নির্ভর না করে, উপকারী পোকা ব্যবহার ও জৈবিক পদ্ধতির সমন্বয়।
৩. জলসাশ্রয়ী প্রযুক্তি:
ড্রিপ ইরিগেশন বা স্প্রিংকলার ব্যবহার করে পানির অপচয় রোধ এবং খরায় টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়ানো।
৪. ফসল বৈচিত্র্য :
একই জমিতে বারবার একই ফসল না করে বিভিন্ন ফসল ঘুরিয়ে চাষ, যাতে মাটির পুষ্টি বজায় থাকে ও রোগপ্রবণতা কমে।
৫. ক্লাইমেট-স্মার্ট এগ্রিকালচার:
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় অভিযোজিত প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন খরা বা বন্যা সহিষ্ণু জাত, পূর্বাভাস-নির্ভর কৃষি সিদ্ধান্ত।
টেকসই কৃষি শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি করে না, এটি কৃষকের জীবনমান, পুষ্টি, এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
🛑 বাংলাদেশে জৈব প্রযুক্তির বাস্তবতা
বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই কৃষি ও জীবপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে:
- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) জৈব প্রযুক্তিভিত্তিক উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে।
- জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে সরকার জাতীয় নীতিমালা ও গবেষণার জন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়নে কাজ করছে।
যদিও জৈব প্রযুক্তি খাদ্য নিরাপত্তায় সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
- জিএম ফসল নিয়ে জনসচেতনতা ও বিভ্রান্তি
- জৈব প্রযুক্তির পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে বিতর্ক
- উন্নত প্রযুক্তির অভাব ও গবেষণায় সীমাবদ্ধতা
- বীজের মালিকানা ও বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য
তবে এসব চ্যালেঞ্জ তথ্যভিত্তিক জনসচেতনতা, গবেষণায় বিনিয়োগ, এবং সরকার-শিক্ষা-প্রযুক্তি খাতের সমন্বয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব।
🛑 উপসংহার
জৈব প্রযুক্তি শুধু কৃষির উৎপাদন বাড়ায় না, এটি স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে সক্ষম। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের প্রয়োজন একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা। সে দিক থেকে জৈব প্রযুক্তি হতে পারে ভবিষ্যতের ভরসা।
বাংলাদেশ যদি এই প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারে, তবে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ হওয়া অসম্ভব নয়।